ইতিহাস কেবল অতীতের দলিল নয়; এটি ভবিষ্যতের জন্য এক আয়না। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় কিছু কিছু সাল চিরকাল বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে—তেমনই একটি বছর ১৯৪১। আর বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালও যেন সেই একই ছায়ার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি করছে। দুই সময়ের মধ্যে প্রায় ৮৪ বছরের ব্যবধান হলেও, একাধিক ঘটনা, প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক সংকট এই দুই সময়কে অভিন্ন সূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
১৯৪১ সাল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিঝরা সময়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ চালায়, জাপান পার্ল হারবারে হামলা করে, আর বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক ধ্বংস, শরণার্থী সমস্যা এবং রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন। এই সময়টিকে মানুষ স্মরণ করে আতঙ্ক, প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের যুগ হিসেবে।
২০২৫ সালের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এক নতুন উত্তেজনার আবহ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখনো থেমে যায়নি, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়ছে, আর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন বিরোধ আবারও আগুন হয়ে জ্বলছে। এমনকি অনেক বিশ্লেষক বলছেন—এই দশক হতে পারে ভবিষ্যতের “ওয়ার্নিং ডিকেড”, যেখানে একটি আঞ্চলিক সংঘাতও বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ১৯৪১ সালের ভূরাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ।
শুধু যুদ্ধই নয়, জনস্বাস্থ্য ও মানবিক সংকটের দিক থেকেও রয়েছে বিস্ময়কর মিল। ১৯৪১ সালে বিশ্ববাসী যুদ্ধজনিত খাদ্যসংকট ও মহামারির আতঙ্কে দিন পার করেছে। আর ২০২৫ সালেও আমরা কোভিড-১৯ মহামারির পরবর্তী অভিঘাত মোকাবিলা করছি—নতুন ভাইরাস, ওষুধের ঘাটতি, এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা বিশ্বকে দুশ্চিন্তায় রেখেছে।
প্রযুক্তির দিক দিয়েও ইতিহাস যেন একই পথে হাঁটছে। ১৯৪১ সালে এনিগমা কোড ভেঙে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। আজ ২০২৫ সালে প্রযুক্তির যুদ্ধ হচ্ছে সাইবার জগতে—এআই, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ডেটা নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মাধ্যমে। যুদ্ধক্ষেত্র এখন আর শুধু মাটি বা আকাশে নয়, বরং মাউস ক্লিকের মাধ্যমে চালানো হয় তথ্য যুদ্ধ।
অর্থনৈতিক দিকটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৪১ সালের যুদ্ধ-অর্থনীতি আজ পরিণত হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও সরবরাহ সংকটের আধুনিক রূপে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রযুক্তি নির্ভরতা এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাস্যতা ২০২৫ সালকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—এই মিলগুলো কি কেবল কাকতালীয়? নাকি সত্যিই ইতিহাস নিজের পথ পুনরায় হাঁটছে? ইতিহাসবিদদের মতে, অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতেও আমরা একই ভুল করতে বাধ্য। আর তাই ২০২৫ সালকে ১৯৪১-এর মতো দুর্যোগের বছরে পরিণত হতে না দেওয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উচিত হবে কূটনৈতিক সহনশীলতা, প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ, এবং মানবিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার চর্চা করা।
সবশেষে বলা যায়—ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে পারে, তবে মানুষের হাতে রয়েছে সেই চক্র ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়ার ক্ষমতা।
মোঃ রাফিউ হাসান হামজা
লেখক