আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে শাহরাস্তির অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে এক ভয়াবহ নেশা—অনলাইন জুয়া। মোবাইল স্ক্রিনের কয়েকটি টোকায় শুরু হওয়া এই খেলা আজ অনেকের জীবনে পরিণত হয়েছে বিভীষিকায়। তরুণদের কৌতূহল আর হালকা বিনোদনের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও, তা এখন গিলে ফেলছে সংসার, সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ। একে অনেকে তুলনা করছেন নতুন প্রজন্মের ‘মানসিক মাদক’-এর সঙ্গে।
শাহরাস্তিতে এখন অনলাইন বেটিং সাইটগুলো যেন এক প্রকার ওপেন সিক্রেট। সিএনজি চালক, ক্ষুদ্র দোকানদার, ছাত্র কিংবা গৃহবধূ—প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে এর ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কেউ শুরু করছেন ৫০ টাকার খেলা দিয়ে, কেউবা একবার জিতে কয়েক হাজার টাকা ঢেলে ফেলছেন ‘আবার জিতব’ ভেবে। প্রতিদিন কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
বিশেষ করে ক্রিকেটের মৌসুম, যেমন আইপিএলের সময় এই আসক্তির মাত্রা বেড়ে যায় বহু গুণে। একাধিক সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট সক্রিয়ভাবে নতুন গ্রাহককে আকৃষ্ট করে তুলছে নানা প্রলোভনে। তারা এমনভাবে কৌশলগতভাবে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে যে, একবার ঢুকলেই বের হওয়া মুশকিল। অনেকে প্রথমে লাভের মুখ দেখে ধরা পড়ে আরও গভীরে।
এই নেশার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে এর সামাজিক প্রভাব। অনেক পরিবারে দেখা যাচ্ছে চরম অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, আর্থিক সংকট ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। একাধিক ব্যক্তি চাকরি কিংবা ব্যবসা হারিয়ে এখন ঘরবন্দি, কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে চালিয়ে যাচ্ছেন এই খেলায় হারানো টাকা ফেরত পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা। শাহরাস্তির বাজার এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, “শুরুর দিকে শুধু অবসরে খেলতাম। এখন বুঝি, জীবনটাই খেলায় আটকে গেছে।”
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এত বড় সামাজিক সংকট হয়েও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের তরফে একাধিকবার অনলাইন বেটিং সাইট বন্ধের ঘোষণা এলেও, বাস্তবে তা স্থায়ী হচ্ছে না। VPN ব্যবহার করে বা নতুন ডোমেইনের মাধ্যমে আবার সচল হয়ে উঠছে এসব সাইট। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে।
এই ভয়ঙ্কর আসক্তি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে চাই সমন্বিত উদ্যোগ। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের অংশগ্রহণ, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কার্যক্রম এখন সময়ের দাবি। কারণ, এখনই যদি জেগে না ওঠে প্রশাসন ও সমাজ, তাহলে এই অদৃশ্য ফাঁদে প্রতিদিন হারিয়ে যাবে আরও কিছু জীবন, আরও কিছু পরিবার। আমরা তখন হয়তো শুধু নীরব দর্শক হয়ে দেখব একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্মের পতন।