চাঁদপুরের শাহরাস্তির সূচীপাড়া বাজারে অবস্থিত জনতা ব্যাংক শাখায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা স্থানীয় জনগণ তো বটেই, গোটা ব্যাংকিং খাতের বিবেক নাড়া দিয়েছে। ৮৪ লাখ টাকার এক দুর্নীতির অভিযোগে এক সিনিয়র অফিসার গ্রেফতার, আর পরদিন তার সহকর্মী রাকিবুল হাসানের আত্মহত্যা। দৃশ্যত দুটি আলাদা ঘটনা মনে হলেও এর মাঝেই লুকিয়ে আছে অনেক অদৃশ্য যোগসূত্র—যা এখনো অজানা প্রশাসনের কাছে।
রাকিবুলের মৃত্যুর পর উদ্ধার হওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, “জাবেদ ভাইকে আমি মাফ করে দিলাম।” এই একটি লাইন যেনো গোটা ঘটনার কেন্দ্রে ঘূর্ণি তৈরি করেছে। কেন একজন সিনিয়র ব্যাংক অফিসার, যিনি বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, কর্মস্থলে সৎ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি সম্পন্ন বলে পরিচিত, হঠাৎ এমন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেবেন? যদি তিনি প্রকৃত অপরাধীই হতেন, তাহলে মাফ করে দেওয়ার জায়গা থাকতো না। বরং ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হয়তো ছিলেন এই দুর্নীতির শিকার বা জানতেন এমন কিছু, যা প্রকাশ হওয়ার আগেই চাপের মুখে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় তাকে।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত জাবেদ হোসাইন আরটিজিএস পদ্ধতির অপব্যবহার করে বহু ভুয়া অ্যাকাউন্টে বিশাল অংকের টাকা স্থানান্তর করেন, যেগুলো সংশ্লিষ্ট কোনো সরকারি লেনদেনে যুক্ত নয়। এ লেনদেন চলেছে টানা প্রায় দুই মাস। প্রশ্ন উঠছে, এতদিন ধরে এমন ভয়াবহ কারচুপি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বা উচ্চপদস্থ কেউ জানতেন না? কার্তিক চন্দ্র ঘোষ—শাখা ব্যবস্থাপক—এই লেনদেনের সময় কোথায় ছিলেন?
অনেকেই বলছেন, রাকিবুল হয়তো নিজের আইডি ব্যবহারের বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করেছিলেন, কিংবা জাবেদ তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন দোষ তার উপর যাবে না। কিন্তু পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেলে রাকিবুল বুঝতে পারেন তিনি আটকে গেছেন এমন এক জালে, যেখান থেকে মুক্তির পথ কেবল আত্মপ্রশমনের একমাত্র চিঠি ও দড়ির ফাঁস।
এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতে আলোচিত কিছু আত্মহত্যা ও দুর্নীতির ঘটনার কথা—যেমন হলমার্ক কেলেঙ্কারির সময় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের হঠাৎ অপসারণ, বা বেসিক ব্যাংক দুর্নীতির পর নির্দোষ কর্মীদের শাস্তি আর প্রকৃত দোষীদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। জনতা ব্যাংকের ঘটনাও কি সেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি?
এই ঘটনায় প্রশাসনের দায়িত্ব এখন দ্বিগুণ। শুধু রাকিবুলের মৃত্যুকে ‘সাধারণ আত্মহত্যা’ হিসেবে গণ্য করলে অন্যায় হবে। বরং দরকার ব্যাংকের পুরো ডিজিটাল লেনদেন, কর্মকর্তাদের কথোপকথন, সিসিটিভি ফুটেজ, ও চিরকুটের ফরেনসিক বিশ্লেষণ। পরিবার, সহকর্মী, এবং ব্যাংকের গ্রাহকরা এখন প্রশাসনের দিকে চেয়ে আছেন এই ট্র্যাজেডির আসল কারণ জানার জন্য।
সবশেষে, প্রশ্ন একটাই: “রাকিবুল মাফ করে গেলেন” ঠিক আছে, কিন্তু দেশ কি তাকে ভুলে যাবে? না কি প্রশাসনের একটি নিরপেক্ষ ও সাহসী তদন্ত তার নামে আবার সম্মান ফিরিয়ে আনবে?