
চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের চাঁন্দল কুঠিবাড়ির বাসিন্দা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ সফিকুর রহমান আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ সকাল ৬:৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার ছেলে, চিতোষী ডিগ্রি কলেজ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোঃ ফখরুল ইসলাম পাটোয়ারী বাবার লাশ দেখতে পারেননি, জানাজায় অংশ নিতে পারেননি, এমনকি দাফনেও উপস্থিত থাকতে পারেননি।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে, যা তাকে দীর্ঘদিন ধরে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছে। বাবার মৃত্যুর পরও সেই মামলার আতঙ্কে তিনি গ্রামে ফিরতে পারেননি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও দমন-পীড়ন নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সময় এমন বহু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা এবং এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
এক সময়ের শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। দলীয় আধিপত্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, যা সংগঠনটির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে সংগঠনটি।
এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অসংখ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। দলীয় পরিচয়ের কারণে অনেকেই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগেছেন বা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ হাসান বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, তাদের এলাকা ছাড়া করা একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা যখন এতটাই ব্যক্তিগত হয়ে যায় যে, একজন সন্তান তার বাবার জানাজায়ও অংশ নিতে পারে না, তখন বুঝতে হবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভয়াবহ এক অবস্থার দিকে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সেবা, প্রতিশোধ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা এবং বিরোধী দলের কর্মীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করা। নতুবা এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতেও বহু পরিবারকে এমন কষ্টের মুখোমুখি হতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করা। প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার রয়েছে, এবং কারও মৌলিক মানবিক অধিকারের ওপর রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা: দল বদল, মামলা ও দমন-পীড়ন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চালানো একটি প্রচলিত সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। দল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মামলা হয়, নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়ান, অনেকেই গ্রেপ্তার হন, আবার কেউ কেউ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ পরিবারগুলো।
ফখরুল ইসলামের পরিবারও এই নির্মম পরিস্থিতির শিকার। তিনি ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে অন্যতম, কিন্তু বাবার মৃত্যুতে পরিবার-পরিজনের পাশে থাকার সুযোগও তার হয়নি।
রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে একজন সাধারণ নাগরিক তার পরিবারের পাশে থাকতে পারবে না—এমন বাস্তবতা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতি আর না ঘটে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
আমরা কি এমন দেশ চেয়েছিলাম যেখানে একজন সন্তান বাবার জানাজায়ও থাকতে পারবে না? এখন সময় এসেছে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এবং ব্যবস্থা নেওয়ার।