চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী দক্ষিন ইউনিয়নের বিজয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গত কয়েকদিন ধরে চলমান সৃষ্ট ঝামেলায় ব্যহত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
প্রধান শিক্ষক অপসারণ, ছাত্রীদের সাথে প্রধান শিক্ষকের শ্লীলতাহানি এবং তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারী রবিন চন্দ্র দাসের চাকুরী হতে অব্যহতি নিয়ে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের উপর সাবেক মেম্বার শাহে ইমরান দিপু’র বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিত হামলার মতো গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী রবিন চন্দ্র দাস ও প্রধান শিক্ষক একে অপরের সাথে বাজে আচরণের মতো গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে।
বিদ্যালয়টির অভ্যন্তরীন বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের হঠকারিতায় ব্যহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীরা গত রবিবার হতে আন্দোলন করে ক্লাস বর্জনের পাশাপাশি প্রধান শিক্ষক মো মোক্তার হোসেনের পদত্যাগ দাবিতে সরব। এই ইন্ধনকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। এতে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে জানিয়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।
প্রধান শিক্ষক ও রবিন চন্দ্র দাসের দ্বন্দ্বঃ
তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী রবিন চন্দ্র দাস বিদ্যালয়ে গত রবিবার থেকে অনুপস্থিত। রবিন চন্দ্র দাস চাকুরী হতে অব্যহতি নিয়েছে মর্মে বিদ্যালয়ের ওয়াটসআপ গ্রুপে মেসেজ দিয়ে রাখলেও অফিসিয়াল কোন কাগজ দেখাতে পারেন নি প্রধান শিক্ষক। অব্যহতির বিষয়ে প্রধান শিক্ষক কিছু জানেন না বলেও জানান।
বিজয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরের গ্রুপে রবিন চন্দ্র দাস গত বৃহস্পতিবার একটি টেক্সট করেন, যা হুবহু তুলে ধরা হলো:
“আমি আমার চাকুরি হতে অব্যহতি নিলাম, কে কতটুকু পাগলামি করতে পারে আমি দেখে ছাড়বো, ভদ্রতার রূপ দেখছে.”
প্রধান শিক্ষককে তার অব্যহতির বিষয়ে প্রতিবেদক জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে প্রতিদিন সে ঠিক সময়ে আসতো না। তাকে হিসাবরক্ষক হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে গত বছরের নভেম্বর হতে “কলামনার ক্যাশ বই”তে হিসাব লিপিবদ্ধ করছে না। এই হিসাব লিপিবদ্ধের জন্য তাকে বারংবার তাগাদা দেয়ার পরেও তার নিজের কাজের ব্যাপারে সে উদাসীন ছিলো৷ সব সময় এলাকার ও দলীয় পরিচয়ে শিক্ষাঙ্গনে উশৃঙ্খল আচরণ করতো। প্রধান শিক্ষক হিসেবে সে আমার কোন কথাই ঠিক মতো শুনতো না। বরং বাজে ব্যবহার করতো। যা বিগত ম্যানেজিং কমেটির সকলেই অবগত ছিলো।
অভিযোগের ব্যাপারে রবিন চন্দ্র দাসকে ফোন দিলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগই মিথ্যা। বিদ্যালয়ের সকলেই ১০ টায় আসলেও আমার আসার কথা ৯:৩০ মিনিটে। তবে প্রধান শিক্ষক প্রতিদিন আমাকে ৯ টায় উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেন। আমাকে দিয়ে বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ তিনি করিয়ে নিতেন৷ বিদ্যালয় ছুটির পরেও আমাকে দিয়ে তিনি কাজ করাতেন৷ আমি এসব নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন তিনি৷
রেজিস্টার মেইনটেইন কেন করতেন না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের সকল ব্যাংক জমার হিসাব আমার কাছে ছিলো, তবে যাবতীয় আয় ও ব্যয়ের হিসাব প্রধান শিক্ষক নিজেই রাখতেন। আমাকে সকল তথ্য না দিলে আমি কিভাবে তা লিপিবদ্ধ করবো। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক এই রেজিষ্টার মেইনটেইন করতেন, হুট করে আমাকে প্রধান শিক্ষক মোঃ মোক্তার হোসেন হিসাবের সকল কিছুর কাগজ না দিয়ে লিপিবদ্ধ করতে বলেন। গত বছরের নভেম্বর থেকে এজন্যই রেজিষ্টার বইতে কিছু লিপিবদ্ধ হয় নি।
অডিট কমিটি রেজিষ্টার বই চেক করতো কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোন অডিট কমিটি আমাদের হিসাব দেখতে চায় নি। এক বছরে বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব গভর্ণিং বডির সদস্যরা নেয় নি, তা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ?
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরিধিঃ
গত বৃহস্পতিবার হুট করে রবিন চন্দ্র দাস নিজেই অব্যহতি নেয়ার পর রবিবার থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে এবং ক্লাস বর্জন করে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে মূল এজেন্ডা ছিলো প্রধান শিক্ষক মোঃ মোক্তার হোসেনের পদত্যাগ ও রবিন চন্দ্র দাসকে পূর্ণবহাল।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিবেদক কথা হলে তারা বলেন, প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের শরীরের বিভিন্ন সময়ে খারাপ নজরে হাত বুলাতেন৷ পাশাপাশি কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সাথে বাজে আচরণ করতেন, এমনকি গালাগালিও করতেন। এই বিষয়ে গত জুন মাসে বিদ্যালয়ে বসে ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকাবাসী বসে তাকে সতর্ক করে দেয়া হয় বলেও তারা জানান।
বিদ্যালয়ের বাকি শিক্ষকদের সাথে আন্দোলনের ব্যাপারে কথা বললে তারা এ ব্যাপারে কোন কথা বলবে না বলে জানায় প্রতিবেদককে। তাছাড়া সকল শিক্ষকই ক্লাস করার পক্ষে বলে জানান অনেকে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর সাবেক মেম্বারের হামলাঃ
মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিভৃত করতে এগিয়ে আসেন এলাকার সাবেক মেম্বার শাহে ইমরান দিপুসহ এলাকাবাসীরা৷ তারা সকলেই ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ্বস্থ করার পর শিক্ষার্থীরা বাজে আচরণ করলে তাৎক্ষণিক হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী।
শিক্ষার্থীরা জানান, সাবেক মেম্বার দিপু তাদের উপর হামলা ও বাজে ব্যবহার করেছেন৷ এই হামলার বিচার দাবি করেন তারা। তারা উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার কাছে বিচার দিতে যাবেন বলে জানান৷
একই বিষয়ে সাবেক মেম্বার দিপুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি তাচ্ছিল্য করে বলেন, শিক্ষার্থীরা সকলেই আমার এলাকার সন্তান। তাদের শরীরে আমি কোন আঘাত করি নি। বরং তাদেরকে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা আমার ও গ্রামবাসীর উপর ক্ষেপে যায়। তাদের শরীরে আঘাত করার কোন প্রশ্নই উঠে না!
প্রধান শিক্ষক মোঃ মোক্তার হোসেন সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বলেন, আমি রোষানলের স্বীকার। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানকে ভালো অবস্থানে আনার পর আমার ব্যাপারে এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে আমি মর্মাহত ও শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত।
উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোঃ ইয়াসির আরাফাত বলেন, উদ্ভট পরিস্থিতির ব্যাপারে আমি অবগত হয়েছি। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষককে তদন্ত রিপোর্টের আগ পর্যন্ত ছুটিতে থাকতে এবং শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যোগদান করতে বলা হয়েছে।