২৬ জুন ১৮৩৮ সালে ভারত, পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নোহাটি শহরের কাঁঠাল পাড়া গ্রামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়।
উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি উপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাকে সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা উপন্যাসিক হিসাবে গণ্য করা হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ের সময় বয়স ছিল মাত্র দশ । পাত্রীর নাম মোহিনী । কাঁঠালপাড়ার কাছে নারায়ণপুর গ্রামের নবকুমার চক্রবর্তী র মেয়ে, তার বয়স তখন মাত্র পাঁচ । বালক বর – বৌয়ের বড়ো ভাব -তারা একসঙ্গে খেলে গল্প করে । বঙ্কিমের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মোহিনীর দাদু রামমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে মোহিনী বাপের বাড়ি ফিরে গেলো । সিদ্ধান্ত হল পাত্রী কিছুদিন পিত্রালয়ে থাকবে। বঙ্কিম কিন্তু এই বিরহ সহ্য করতে পারছিলেন না। প্রায় -রাতেই বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লেই চুপি চুপি বালক বঙ্কিম মাইল দেড়েক পথ ছুটে এসে হাজির হতেন শ্বশুর বাড়ি। ভোর হতে না হতেই আবার এক ছুটে নিজের বাড়িতে ফিরে পড়তে বসা। সাহিত্য সম্রাট আচ্ছন্ন বাল্য প্রণয়ে। তা বলে পড়াশুনোতে কিন্তু কোনো ব্যাঘাত ঘটতে দেন নি কখনও।
১৮৫৮ সালে ৭ই আগস্ট বঙ্কিমের কর্মজীবন শুরু হলো । কুড়ি বছরের বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে চললেন যশোরে , মোহিনীর তখন বয়স পনেরো। স্বামীকে কিছুতেই একলা ছাড়তে চাইলেন না স্ত্রী। স্ত্রী কে অনেক বুঝিয়ে রওনা হলেন বঙ্কিম। পত্নী বিরহে কাতর বঙ্কিম ঠিক করলেন সামনের বছরেই নিয়ে আসবেন স্ত্রীকে। কিন্তু এরমধ্যেই কয়েকদিনের জ্বরে মারা গেলেন মোহিনী ১৮৫৯ সালে। শোকাহত বঙ্কিম ভাইকে লিখলেন মোহিনী কে যে কানের দুল আর চুলের কাঁটা কিনে দিয়েছিলেন তা যেনো তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমৃত্যু বঙ্কিম ঐ দুটো নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।
পত্নীহারা বঙ্কিম তখন বিপর্যস্থ –পুনর্বিবাহের প্রস্তাব না করে দিয়েছেন তিনি। সেই সময় বঙ্কিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের উদ্যোগে উনি দ্বিতীয় বিবাহ করতে রাজি হলেন, রোগা ধাঁচের হালিশহরের গোবিন্দ রায়চৌধুরীর মেয়ে রাজলক্ষ্মীকে। পরবর্তী কালে বঙ্কিম দ্বিতীয় স্ত্রীর অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন বারংবার। অসাধারণ রূপবতীর পাশাপাশি গুণবতী মহিলা ছিলেন রাজলক্ষ্মী। ৩৪ বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল বঙ্কিম -রাজলক্ষ্মীর,৩ কন্যার পিতা-মাতাও ছিলেন তারা। ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ সালে বঙ্কিম মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্কিমের মৃত্যুর ২৫ বছর পরে ১৯১৯ সালের ২৭শে আগস্ট মারা যান রাজলক্ষ্মী।
বঙ্কিম প্রথম প্রথম স্থী মোহিনী কে ভুলতে পারেন নি। বঙ্কিমের বহু উপন্যাসে এর ছায়া পাওয়া যায়- যেমন ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে তিলোত্তমার যে বর্ণনা , তার সঙ্গেও সাদৃশ্য পাওয়া যায় মোহিনীর । এই উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদে তিলোত্তমার বর্ণনায় আছে —
‘ পাঠক ! কখনও কিশোর বয়সে কোন স্থির, ধীরে, কোমল-প্রকৃতি কিশোরীর নব সঞ্চারিত লাবণ্য প্রেমচক্ষুতে দেখিয়াছেন ? একবার মাত্র দেখিয়া চিরজীবনের মধ্যে যাহার মাধুর্য্য বিস্মৃত হইতে পারেন নাই – যে মূর্তি সন্ধ্যাসমিরণ-কম্পিত বসন্তলতার ন্যায় স্মৃতিমধ্যে দুলিতে থাকে, এ সেই মূর্তি – তিলোত্তমার বয়স ষোড়শ বৎসর ; সুতরাং দেহায়তন প্রগলভবয়সী রমণীদিগের ন্যায় অদ্যাপি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় নাই । দেহায়তনেও মুখাবয়বে কিঞ্চিৎ বালিকা ভাব ছিল ।’
এই কে সেই অপরিণিতা বালিকা বধূ যার নাম ছিল মোহিনী ?
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের উপক্রমণিকাতে বালকের ন্যায় কেহ ভালোবাসিতে জানে না ‘ ,তখন কি মনে হয় না বঙ্কিমের বাল্য প্রেমের কথা । কিংবা ঐ উপন্যাসেই পাওয়া যায় –‘ “এইরুপে ভালবাসা জন্মিল। প্রনয় বলিতে হয় বল, না বলিতে হয়,না বল। ষোল বৎসরের নায়ক -আট বৎসরের নায়িকা। বালকের ন্যায় কেহ ভালবাসিতে জানে না। বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালোবাসিয়াছ, তাহাদের কয়জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা সাক্ষাৎ হয় ? কয়জন বাঁচিয়া থাকে …?“
এও কি মোহিনী কে উদ্ধেশ্য করে নয় ?
মোহিনীর সঙ্গে মাত্র দশ বছরের বাল্য দাম্পত্য জীবন বঙ্কিমের । তবু বঙ্কিম চিরকাল মনে রেখেছিলেন প্রথম পত্নীর প্রেম । বঙ্কিমের গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রের অকালমৃত্যু একটি সাধারণ লক্ষণ । এখানেও ছাপ ফেলে গিয়েছে ষোল বছর বয়সেই আচমকা চলে যাওয়া মোহিনী।
তা বলে বঙ্কিম কখনো তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে অমর্যাদা করেন নি – যথেষ্ট ভালোবাসা দিয়েছেন । রাজলক্ষ্মী দেবী জানতেন বঙ্কিমের প্রথম পত্নীর প্রতি প্রেমের কথা –কোনোদিন আপত্তি করেন নি । মোহিনীর মৃত্যুর দিন নিয়ম করে প্রদীপ জ্বালাতেন , শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন, নিরামিষ খেতেন । আর এই নিয়মটা রাজলক্ষ্মী দেবী বঙ্কিমচন্দ্র মারা যাওয়ার পরেও সারা জীবন পালন করে এসেছিলেন ।